রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে হকার উচ্ছেদ আর পাল্টা দখলের রাজনীতি গত তিন যুগ ধরে চলছে। এর মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত হকারদের উপর চাঁদার হার বাড়ছে। আর সেই টাকার ভাগ নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, সিটি করপোরেশনের একশ্রেনির কর্মকর্তা, স্থানীয় সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে অনেকেই। হকারদের কাছ থেকে পাওয়া এক হিসাব থেকে জানা যায়, রাজধানীর গুলিস্তানেই শুধু প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। ৩০ জন লাইনম্যান এই টাকা তোলেন। জমা হয় ক্যাশিয়ার দুলালের কাছে। সেখান থেকে ভাগ হয়ে যায় সবখানে।
হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, ‘আমরা বাঁচতে চাই, ঝামেলামুক্তভাবে জীবন যাপন করতে চাই। তাই সরকার আমাদের পুনর্বাসনের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। বিভিন্ন চাপে আমরা পিষ্ট। আমরা আর বেঁচে থাকতে পারছি না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান প্রতিটি হকার। সারাদেশে আমাদের ফেডারেশনের সদস্য আছে প্রায় ২৫ লাখ। ’
গত ১৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের বৈঠকে হকারদের পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এরপর সিটি করপোরেশন থেকে উদ্যোগ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাবসহ সব পক্ষের উপস্থিতিতে গুলিস্তান এলাকার হকারদের একটি তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকায় দুই হাজার ৫০২ জন হকারের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পুরোপুরি পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে তাদের সাময়িক বসার ব্যবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। কিন্তু এই ব্যবস্থায় বাদ সাধে চাঁদা পাওয়া গ্রুপগুলো।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাঈদ খোকন বলেন, এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমরা যেভাবে উদ্যোগ নিয়েছি সকলের সহযোগিতায় হকারদের পুনর্বাসনে আমরা সফল হব।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হকাররা পুনর্বাসিত হলে চাঁদার ভাগ বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে মঙ্গলবার হকারদের উচ্ছেদের সময় একটি পক্ষকে উসকে দিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত করা হয়। এর নেপথ্যে থেকে কাজ করেছে যারা চাঁদা পায় তাদের সবক’টি গ্রুপ। এমনকি পুলিশ ও সরকার দলীয় কতিপয় নেতারও ইন্ধন রয়েছে। আবার উচ্ছেদের পর হকারদের ডেকে বলা হয়েছে, তোমরা জায়গা ছেড়ে দিলে অন্য কেউ দখল করে নেবে। যে যার জায়গায় আবার বসে পড়ো। ফলে বাধ্য হয়েই হকাররা উচ্ছেদের পরদিন আবার বসে পড়েন।
এরশাদের শাসনামল থেকেই হকারদের নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা চলে। এক একজন হকারের কাছ থেকে দৈনিক একশ’ টাকা থেকে শুরু করে দোকান ভেদে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এর সঙ্গে আছে ফাও কাপড় নিয়ে যাওয়া, দোকানে ফাও খাওয়াসহ অনেক কিছু। আর হকারদের প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হওয়া, মারধর খাওয়ার ঘটনা তো আছেই। নিয়ম অনুযায়ী লাইনম্যানরা চাঁদা সংগ্রহ করেন। জমা দেন ক্যাশিয়ারের কাছে। আর বাবুল নামে গুলিস্তানে এক সর্দার আছে যার কাজ দেখভাল করা এবং কেউ টাকা না দিলে সেটা জোর করে উদ্ধার করা। যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকারের এক শ্রেনির দলীয় নেতারা গুলিস্তানসহ রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাত দখল করে নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ নিয়ন্ত্রণের আধিপত্য নিয়ে খুন-খারাবিও হয়েছে। এই চিত্র সব জায়গায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমাদেরও এক শ্রেনির লোক এর সঙ্গে জড়িত।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সরকার হকারদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়। তখন রাস্তা থেকে হকারদের উচ্ছেদ করে হলিডে মার্কেট চালু করা হয়। এই মার্কেটেও দখল নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। রাতের বেলায় হকাররা ঘুমিয়ে থাকত জায়গা দখলের জন্য। না হলে সকালে অন্য কেউ জায়গা দখল করে নিত। ওই সময় জায়গা দখল করে ঘুমিয়ে ছিল রিয়াজ ও সুমন নামে দুই যুবক। রাতের আঁধারেই তাদের ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করে। সেই থেকে হলিডে মার্কেটও বন্ধ হয়ে যায়। আবার পুরনো জায়গায় ফিরে আসে হকাররা। এখন আবার নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু তিন দশকে উচ্ছেদ আর পুনর্বাসনের মধ্যেই আটকে আছে এই চিত্র।